বিপ্লবী অস্তিত্বে নজরুল

জ্যোতির্ময় বসু:বিপ্লব ও প্রেম-নজরুলের মাঝে এই দ্বৈত সত্তা। নজরুল একাধারে বিপ্লবী অন্যধারে প্রেমিক। এই দুইয়ের মাঝে নজরুলের জীবনে কোনটি প্রধান?
বিপ্লবী সাহিত্য সাধারণত ইজম ভিত্তিক হয়ে থাকে। ‘ইজম’ আশ্রয়ী কোনো কাব্য বা সাহিত্যের রূপ হচ্ছে শিল্পগত পদ্ধতিতে তার প্রয়োগের তত্ত্ব ও সমন্বয় সাধন।’ যেমন সাম্যবাদ অর্থে, ‘সার্বজনীন-সার্বজনীন ভূমি, সার্বজনীন কলকারখানা, সার্বজনীন শ্রম ইত্যাদি।
কবির ভাষায় বলি,
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি, এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশী।’
কিংবা- ‘আমি সকল দেশের সকল জাতের।’
অথবা- ‘আমার কন্ঠের এই প্রলয় হুঙ্কার একা আমার নয়, সে যে নিখিল আর্তপীড়িত আত্মার যন্ত্রণা।’ এমনি সুরে বিশ্বজনীন মানবতা এবং আত্মপীড়িতের আন্তর্জাতিকতার রূপ ফুটে ওঠে।
‘আমাদের যুক্তিতর্ক নাই, কাণ্ডজ্ঞান নাই’ বা ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’। এমনি ধ্বনি মুক্ত প্রাণধর্মের অস্থিরতায় প্রাণবন্ত এবং মহান উজ্জীবন সঙ্গীতে ভরপুর। কিন্তু বিপ্লবী আদর্শের পরিস্ফুটন কোথায়? কারণ ‘বিপ্লব এক দর্শন, রণনীতিগত এক কর্মধারা। নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে এর প্রক্রিয়া অগ্রাভিমুখী।’ তাই যুক্তি নির্ভর তত্ত্বে নির্দেশিত রণনীতিগত পথে এর ক্রম অগ্রাভিযান। তত্ত নিতান্তই যুক্তিনির্ভর বলে উচ্ছ্বাস বর্জর্নীয়। কিন্তু নজরুলের সারা কাব্য জুড়ে আবেগ এবং উচ্ছ্বাসের সীমাহীন প্রাবল্য। উচ্ছ্বস যুক্তিনির্ভর নয় বলে উজ্জ্বল বক্তব্যকে দুর্বল এবং তার স্থায়িত্ব সীমিত করে তোলে। তাঁর জবানীতেই শোনা যাক, ‘যা বলতে চাই তা বেশ ফুটে উঠেনি মনের চপলতার জন্য। আজও হয়তো নিজেকে যেমনটি চাই তেমনটি প্রকাশ করতে পারব না’। উচ্ছ্বাসের আবিলতায় তাঁর চিন্তা কর্ম এবং প্রকাশের এই অনৈক্য বিপ্লবের মতাদর্শগত বিরোধ এবং বিচ্যুতি।
বিপ্লব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং প্রেমও এক স্বীকৃত সত্য। তাই হয়তো বিপ্লবীর প্রেমিক হতে বাধা নেই। কিন্তু শারীর প্রেম প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে বিলাসিতার ছোঁয়াচ পেলে বিপ্লবকে প্রভাবিত সংক্রামিত করার দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। নজরুলের সারা কাব্য- গানে মানবী প্রেমের স্তুতি ব্যাখ্যানের আধিক্য। কবির কথাতেই শোনা যাক, ‘আমার পনর আনা রয়েছে সৃষ্টির ব্যাথায় ডগমগ। আর এক আনা করছে পলিটিকস্, দিচ্ছে বক্তৃতা, গড়ছে সংঘ।’ সমগ্র সত্তার এক দ্রুততম অংশ বিপ্লবে নিয়োজিত এক শারীর প্রেমিকের পক্ষে সার্থক বিপ্লবী হিসেবে উত্তরণের প্রশ্ন তর্কাতীত নয়।
তাঁর ভাষায়- ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’। এই হচ্ছে নজরুলের স্বরূপ, প্রেম ও বিপ্লবের সহ-অবস্থানের রূপ।
বিপ্লবী সাহিত্য বলে আদৌ কোনো সাহিত্য আছে কিনা, অথবা সাহিত্যে বিপ্লবের প্রবেশ এবং তত্ত্ব প্রয়োগে সাহিত্যের ধর্ম অক্ষুন্ন থাকে কিনা, এমনি ধারার প্রশ্নও নতুন কিছু নয়। শাশ্বতবাদী বিশ্ববরেণ্য বহু লেখকের ব্যাখ্যায় হয়তোবা সাহিত্যে বিপ্লব বা বিপ্লবী সাহিত্যের অস্তিত্ব ধোপে টিকেনা।
‘বিদ্রোহ আর জীবন’ প্রবন্ধে শ্রদ্ধেয় আবুল ফজল বলেছেন, ’বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহও ছিল বাহ্যিক বিষয়ে আর খুব সীমিত এলাকা জুড়ে, রাজনীতি আর সামাজিক কিছু কুসংস্কারের ক্ষুদ্র পরিধিতেই তা নিঃশেষিত।’ হুইটম্যান, গোর্কি, ন্যূট হামসুন, আনাতোলা ফ্রাঁস, লু শুন প্রমুখের মতো হয়তোবা নজরুল তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে চিরন্তন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেননি। স্বীকার করি, তবুও একটি প্রশ্ন- নজরুলকে বাদ দিলে আমাদের সাহিত্যের বিপ্লবী অংশের অবশিষ্ট কি? সম্ভবতঃ শূন্য। আবুল ফজলের কথায় এর উত্তর দেওয়া যাক, ‘আশ্চর্য, বিদ্রোহী কবি নজরুল ছাড়া আমাদের সমাজে, এদেশে অন্ততঃ তেমন কোনো বিদ্রোহীর জন্ম হয়নি। আমাদের সাহিত্যের বিপ্লবী অংশে নজরুল এক একক সম্রাট’।
একজন কবি বা সাহিত্যিকের পরবর্তীকালে তার দেশ ও জাতিতে অস্তিত্ব নির্ভর করে সে যুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, মনন, মানসিকতা এবং প্রয়োজনের ওপর। আজকে আমাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে নজরুলের প্রয়োজন অপরিহার্য। আমরা যেমন শূন্যে অবস্থান করতে পারিনা, তেমনি শূন্য হতে বা শুধু শূন্য নিয়ে কিছু শুরুও করতে পারিনা। আমাদের বৈপ্লবিক চেতনায় নজরুলই প্রথম পথিকৃত, একটি উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন।
এক পর্যায়ে নজরুল তাঁর বিপ্লব-সাম্যবাদের জগৎ ছেড়ে অধ্যাত্মজগতে পা বাড়ালেন। ‘ভগবানের বুকে পদচিহ্ন’ এঁকে দেবার মতো দুঃসাহসীকে ভাববাদ বা অধ্যাত্মবাদের প্রবেশ পর্বে তাঁর বিপ্লবী ভক্তদেরকে ব্যথিত করে তোলো। তাঁর কথায়-‘আমার সর্ব অস্তিত্ব, জীবন-মরণ-কর্ম, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ যে তাঁরই নামে শপথ করে তাকে নিবেদন করেছি।’ অথবা-‘ আল্লাহ্ ছাড়া আর কিছুর কামনা আমার নেই’ এমনি আত্মসমর্পিত ভাববাদের আর্তি অনেককে আপ্লুত করে সত্যি, কিন্তু তাঁর অতি পরিচিত ভাবমূর্তিকে ম্লান করে তার বিপ্লবী চেতনা, স্বকীয়তায় কঠিন জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তোলে। তাকে এক স্বাপ্নিক সাম্যবাদীর অধিক ভাবার পরিসর মেলেনা।
আজ জীবনধর্মী বিপ্লবী শিল্প সাহিত্যের যে বিকাশ এবং যার থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন চেতনা এবং মূল্যবোধ সে আলোকে নজরুলের নব নব মূল্যায়ণ তাঁর অবস্থান সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। শুধু নজরুলের স্থায়িত্বের কারণেই নয়, আমাদের অস্তিত্বের খাতিরেও এই মূল্যায়ণ প্রয়োজন। কারণ, আমাদের বিপ্লবী অস্তিত্বের প্রয়োজনে নজরুলের বিপ্লবী স্থায়িত্ব একান্ত অপরিহার্য।
লেখক ও গবেষক, সাবেক উপপরিচালক, বাপাউবো
সূত্র: ওয়েব সাইট
ঢাকা, ০১ েসপ্টেম্বর (ওমেনঅাই)//এসএল//