
মোঃ ইমামুল হক :
২৫ ফেব্রুয়ারি এমন একটি দিন, যে দিনটির কথা হৃদয় থেকে সরিয়ে রাখার সাধ্য আমাদের কারো নেই। এই দিনে আমরা জাতির সেই সব বীর সন্তানদের কথা স্মরণ করি, যারা তাদের সর্বো”চ ত্যাগটুকু করেছিলেন এই দেশের জন্য, যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশ মাতৃকার সেবায়। আর এভাবেই জীবন দিয়ে তারা আমাদের জন্য রেখে গেছেন দেশের প্রতি প্রেম, ত্যাগ, সেবা ও জীবন উৎসর্গ করার শিক্ষা।
বাংলাদেশের ইতিহাস কখনই ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ঢাকার পিলখানায় ঘটে যাওয়া বিডিআর বিদ্রোহ নামের সেই ভয়াবহ ঘটনাটির কথাটি ভুলতে পারবে না, যেখানে দেম মাতৃকার সেবায় অর্পিত দায়িত্ব পালনকালে প্রাণ দিতে হয়েছিল ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪জনকে। তারা শহীদ হয়েছেন বীরের মতো, ইতিহাস তাঁদের যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করবে……চিরদিন।
এসব বীর শহীদদের অনেক বন্ধু, সহকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরা, শোক আর ক্ষোভকে সঙ্গে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চান, তারা নিজ সংস্থার প্রতি এই শহীদদের ঐকান্তিক আনুগত্য, দায়িত্ব পালনের প্রতি প্রতিশ্র“তিশীলতা এবং দেশের প্রতি প্রশ্নাতীত ভালবাসাকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চান। এরকম একটি উদ্যোগই গ্রহণ করেছে কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট, যার মূল উদ্দেশ্য হলো কর্নেল মুজিবসহ সকল শহীদ ভাইদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের বিমূর্ত আত্মার স্মৃতিকে যুগ যুগ চিরঞ্জিব রাখা। ২০০৯ সালে ভয়ানক সেই ঘটনার পর পরই ঘটনার অন্যতম শহীদ কর্নেল মুজিবুল হক- এর নামে শহীদ কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট গঠিত হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদদের আবেগীয় স্মৃতি ধরে রাখা এবং তাদের প্রতি সম্মান জানানোই এর মূল লক্ষ্য।
একটি ঘটনায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে এত অধিক সংখ্যা উচ্চ প্রশিক্ষিত মেধাবী সেনা কর্মকর্তার হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক ইতহাসে আর একটি নাই। আইন তার নিজের গতিতেই চলেছে। আদালত অভিযুক্ত ৮০০ জনের মধ্যে ১৫০ জনকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছেন। যদিও এই বিচার অনেক শহীদ পরিবারকেই সš‘ষ্ট করতে পারেনি বলেই প্রতীয়মান হয়, কারণ সেই বিভৎস ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনও উদঘাটিত হয়নি। এটা যদিও সত্য যে, তাদেরকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, খাবার টিবিলে তাদের শূণ্য চেয়ার শূণ্যই থেকে যাবে, তাদের জন্য হৃদয়কোণে যে শীতল শূণ্যতা তা কোন দিন পুরণ হবার নয়, তবুও এই বিচার হয়তবা কিছু শহীদ পরিবারের সদস্যদের মনের কিঞ্চিৎ সান্ত¦না হিসেবে কাজ করবে। এরপরেও যারা একসঙ্গে এত বিশাল সংখ্যক দক্ষ-ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার হত্যার বিষযটি কোনভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারেন না, তাদের সবার কাছে সব সময় একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, আর সেটা হলো: ‘কেন’? তারা নেপথ্যের কারণগুলো জানতে চান। তাদেও অনেকেই মনে করেন, কোর্টের রায় ঘোষণার পরও সেই সব প্রশ্ন থেমে থাকেনি। এই বিদ্রোহের অনেক কিছুই দেশবাসির কাছে অজানা। জাতীয় নিরাপত্তার স্বাথের্ই এর প্রকৃত কারণ এবং নেপথ্য ব্যক্তিদেরকে সত্যের আলোয় আনতে হবে। আমাদেরকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে সামাজিক নৈতিকতার প্রতি আমাদের বাধ্যবাধ্যকতাও আছে। আমরা যদি আইনের শাসন ও সামাজিক নৈতিকতা থেকে দুরে থাকি তার মানে হবে আমরা আমাদের মাতৃভূমির নিরাপত্তাকেই বিপন্ন করছি।
এত বড় একটি বিদ্রোহ কি কেবল বিডিআর এর কয়েকজন ডিএডি সমমানের কর্মকর্তার পরিকল্পনা হতে পারে? তারা কি বাইরের কোনও শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়নি? সরকারকে এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে এবং সেগুলোকে গ্রহণযোগ্য উপায়ে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।
চলে যাওয়ার সময় অমাদের শহীদ ভাইয়েরা আমাদের বিহ্বল মানসিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে গেছেন। সময়মতো তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় কাজটুকু আমরা করতে পারিনি। জীবদ্দশায় নানা উপলক্ষ্যে দেশে-বিদেশে তাঁরা আমাদের দেশকে গর্বিত করে গেছেন, তাঁরা তাদের বিক্রম দেখিয়েছেন, মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন, সহকর্মীদেরকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। কিন্ত তাদের প্রয়োজনের সময় আমরা তাঁদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। এমনকি সারা জীবন যে প্রতিষ্ঠানের জন্য এত ত্যাগ-এত তিতিক্ষা তাঁরা করে গেলেন, সেই প্রতিষ্ঠান তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াতে পারলো না। কেন এই দুঃখজনক ঘটনাগুলো ঘটলো, কেন আমরা সময়মতো তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারলাম না সেগুলো আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। ভুল থেকে, দুঃখজনক সেই ঘটনা থেকে আমরা কী শিক্ষাটাই নিতে পেরেছি সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
কর্ণেল মুজিব ট্রাস্টের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে আমরা যে শান্তিপূর্ণ মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচির আয়োজন করি তা আমাদের দেশ প্রেমে উজ্জ্বীবিত করতে, জাতিকে গৌরবোজ্জ্বল করতে ওই শহীদদের জীবন উৎসর্গের প্রতীকী রূপকে উপস্থাপন করে। একটি মোমবাতি নিজেকে পুড়িয়ে আমাদের আলো দেয় একইভাবে শহীদ ভাইয়েরা আমাদের আলোকিত করার জন্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। কি বিশাল উপহার! ওইসব শহীদ বীরদের প্রত্যাশা পূরণে তাদের কাছে দেয়া আমাদের প্রতিশ্র“তি নবায়নের দিন হিসেবেও ২৫ ফেব্রুয়ারি গণ্য হওয়া উচিৎ। ওই সব স্বর্গীয় আত্মাদের স্বপ্ন ছিলো সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের যেখানে আমরা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করব। আমাদের মহান দায়িত্ব আজ তাদের সেই স্বপ্ন পুরণে কাজ করা। তাদের পরিকল্পনা ও স্বপ্ন পূরণ এবং মূল্যবোধ ধারণে আমাদের অবশ্যই অঙ্গীকার করতে হবে। সেই সাথে তাদেও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, বীরত্ব এবং দায়িত্ববোধ আগামী প্রজন্মের কাছে পৌছে দেয়ার দায় আমাদের। ২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ সেনা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট আমাদের শহীদ ভাইদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়াজনীয় কাজটি করতে চায়।
জাতি হিসেবে আমরা এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারি না যে, আমরা শুধু এই মূল্যবান জীবনগুলোকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি তা নয়, বরং দেশের জন্য এই বীরদের মূল্যবান অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে পারিনি। যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তাঁরা আত্মত্যাগ করলেন সেই প্রতিষ্ঠানটিও যেন আজ দ্বিধান্বিত, নয়তো কেন আজও ২৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়না। এই জাতির ইতিহাস আত্মত্যাগের ইতিহাস। এ জাতি জানে কিভাবে শহীদদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হয়। আজ শহীদ সেনা দিবসের ৫ম বার্ষিকী পালন কালে আসুন আমরা যথোপযুক্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে আমাদের বীরদের স্মরণ করি।
—–
লেখক জাতিসংঘের একজন সাবেক কর্মকর্তা ও শহীদ কর্ণেল মুজিবুল হকের ভাই