নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ চট্টগ্রামের ডা. নুরুন নাহার

ওমেনআই ডেস্ক: চট্টগ্রামে যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নারী বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে ময়দানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে ডা. নুরুন নাহার জহুর অন্যতম। ডা. নুরুন নাহার জহুর সকলের সাথে খুব সাধারণভাবে মিশে কাজ করতেন যা ছিল তার চরিত্রের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। তিনি মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ করতেন না। তার হৃদয় ছিল সমুদ্রের মত উদার। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। আছে তার রেখে যাওয়া কর্ম ও স্মৃতি। ডা. নুরুন নাহার জহুর ১৯৫২ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত মাঠে ময়দানে নারী আন্দোলনের অগ্রভাগের এক সৈনিকের নাম। তিনি একাধারে ছিলেন ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, আর্তমানবতার চিকিৎসক, সমাজ সংস্কারক, সাহ্যিতিক, লেখক ও সর্বোপরি একজন মমতাময়ী মা। ডা. নুরুন নাহার জহুর ১৯৩২ সালের ১২ ডিসেম্বর বাবার কর্মস্থল বার্মায় জন্ম গ্রহণ করেন (তবে তার পৈত্রিক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার চিকদাইর গ্রামে)। তার পিতা ইঞ্জিনিয়ার ওবাইদুল হক, মাতা সৈয়দা জয়নাব হক। বার্মাতেই তার শৈশবের পড়ালেখার পাঠ শুরু হয়।
১৯৪৯ সালে তিনি গুল-এ-জার বেগম হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে তিনি আইএ পাশ করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুলে ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত থাকাকালে ১৯৫৫ সালে বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব জহুর আহমদ চৌধুরীর সাথে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৯৫৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুল থেকে এল.এম.এফ পাশ করেন। ছাত্রজীবনেই ডা. নুরুন নাহার জহুর তার গৃহশিক্ষক বিপ্লবী কল্পনা দত্তের হাত ধরেই রাজনীতিতে প্রবেশ করার অনুপ্রেরণা পান। সেই থেকে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ডা. নুরুন নাহার জহুর ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ছাত্রীদের নিয়ে মিছিল বের করেন। ১৯৭১সালের ২৫ মার্চে লালদীঘি ময়দানে জয় বাংলা বাহিনীর ও স্বেছাসেবক বাহিনীর মহড়ায় মহিলাদের পক্ষে ডা. নুরুন নাহার জহুর, জাহানারা আঙ্গুর নেতৃত্ব দেন। স্বেছাসেবক বাহিনীর পক্ষে নুর মোহাম্মদ, বদিউল আলম আর জয় বাংলা বাহিনীর পক্ষে মৌলবী ছৈয়দ আহমদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে দেশে যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় তখন ডাক্তার নুরুননাহার জহুরের পরিবারের উপর সীমাহীন দুর্যোগ নেমে আসে। এই কষ্টের মধ্যেও তখন তিনি মুজিবনগরে অনারারি মেডিকেল অফিসার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ছিলেন তমুদ্দুন মজলিসের সক্রিয় সদস্য। ১৯৫০ থেকে ৮১ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
নারীনেত্রী ডা. নুরুন নাহার জহুর রাজনীতির পাশাপাশি শৈশবকাল থেকেই ছিলেন সাহিত্য ও সমাজসেবীমনা। তার মাও ছিলেন একজন সাহিত্যসেবী। সেই মায়ের গুণেরই তার মধ্যে প্রতিফলন ঘটে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তার আদর্শের প্রতীক ছিলেন শামসুন নাহার মাহমুদ, কবি সুফিয়া কামাল ও শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তিনি সংগীত খুব পছন্দ করতেন। আঁকতেন ছবিও। লিখেছেন অনেক কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ। ১৯৪৫ সাল থেকে তার সাহিত্য জীবনের সূচনা ঘটে। তার লেখা নিয়মিত সত্যবার্তায় প্রকাশিত হতো। এছাড়া বেগম, কাফেলা, ইত্তেফাক, আজাদী, কোহিনুর, সৈনিক, পূরর্বীসহ বিভিন্ন সংকলন এবং দৈনিক নয়াবাংলা ও স্বাধীনতার বিশেষ সংখ্যায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘আমার জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে আমি নিরুৎসাহিত না হয়ে উৎসাহ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি বাংলার ১০কোটি মা-বোন ও শিশুদের হাসি ফোটানোর জন্য। আমি চাই দেশে সমৃদ্ধি আসুক। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ উন্নত দেশরূপে পরিচিত হোক। এই আমার জীবনের একমাত্র কামনা।’
রাজনীতি, চিকিৎসাসেবা, সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি সমাজসেবায়ও ছিলেন এগিয়ে। ১৯৪২ সাল থেকে মুকুল মেলা, মুকুল ফৌজের সদস্য, ১৯৫১ সাল থেকে আমাদের মাহফিল, চাঁদের হাট পরিচালনা করেন। আজীবন সমাজ সচেতন ব্যক্তি হিসেবে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ও অবহেলিতদের সংগঠিত ও ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। বিশেষ করে ১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে তার মানবিক কাজকর্ম সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৭৩ সালে পি.সি সরকার জুনিয়রকে দিয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রধানমন্ত্রী(বঙ্গবন্ধু) ত্রাণ তহবিলে তিনি ৮শ টাকা প্রদান করেন। মহিলা সমবায় সমিতি, গার্লস গাইডস্, ক্রীড়া সংস্থা, বাংলাদেশ নারী কল্যাণ ফাউন্ডেশন, নারী পুনর্বাসন বোর্ড, মাতৃসংঘসহ তিনি ১০ থেকে ১৫টি সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৪৯ সালে নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি (আপওয়া) চট্টগ্রাম শাখার সদস্যসহ ১৯৫৭ সাল থেকে বিভিন্ন নির্বাহী পদে ও ১৯৭২ সালে এডহক কমিটির সভানেত্রী, ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি সহসভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতির কারণে বিভিন্ন সময়ে জহুর আহমদ চৌধুরীকে ৮ বছরের অধিক সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু ডা. নুরুননাহার জহুর ভেঙে পড়েননি। ডা. নুরুন নাহার জহুরের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি জীবনটাকে কখনো কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের আর্দ্রতায় ভরা পংকিল বলে ভাবেননি। আবার তাকে ঝড়ের দমকা হাওয়ায় ভীত হতেও দেখা যায়নি। শত দুঃখ কষ্টের দিনেও হাসি মুখে বরণ করে নিতে পারতেন যন্ত্রণাকে। বিগত শতকের পঞ্চাশ ষাট দশকে আমাদের দেশে নারীদের পথচলা সহজ ছিল না। এ পটভূমিতে ডা. নুরুন নাহার জহুরের কর্মসাধনাকে সেই সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর রূপে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রতিকূলতাকে সাহসের সাথে অতিক্রম করে তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
আপলোডেড বাই: অরণ্য সৌরভ